তিন প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা গচ্চা

0

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এখনো উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কনটেইনার ও মিনি ওয়েস্টবিন প্রকল্প শেষ করেছে। একই সঙ্গে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ প্রকল্পও চলছে। এগুলোর পেছনে সংস্থা দুটি হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে। এগুলোসহ গত সাত বছরে দুই সিটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ৩ হাজার ৩২৩ কোটি ব্যয় করেছে। তবুও শৃঙ্খলা আসেনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। এখনো ২০ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রহের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

মিনি ওয়েস্টবিন প্রকল্প : যত্রতত্র বর্জ্য যেন পড়ে না থাকে সে জন্য ২০১৬ সালে সড়কের পাশে মিনি ওয়েস্টবিন স্থাপন করে দুই সিটি করপোরেশন। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) তাদের আওতাধীন এলাকায় ১ হাজারটি বিন স্থাপন করেছে। যার খরচ পড়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। আর ডিএসসিসি তাদের আওতাধীন এলাকায় ১০ হাজার ২৬০টি বিন স্থাপন করে। যাতে খরচ হয় প্রায় ৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সংস্থা দুটি ওয়েস্টবিন প্রকল্পের পেছনে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করেছে। এ প্রকল্পটি বছর না যেতেই ভেস্তে যেতে থাকে। চুরি, অসচেতনতা ও নিয়মিত পরিচ্ছন্ন না করায় দুই বছরের মধ্যে সবকটি বিন নষ্ট হয়ে যায়।

এসটিএস নির্মাণ : বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে নির্ধারিত স্থানে রাখতে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে দুই সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি ৫৪ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টি ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ করেছে। আর বাকি ২২টি ওয়ার্ডে বর্জ্য অপসারণ করার মতো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৯টিতে এসটিএস নির্মাণ করেছে। বাকি ১৬টি ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে উন্মুক্ত স্থান। সব মিলিয়ে দুই সিটির ৩৮ ওয়ার্ডে সেকেন্ডারি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। এসবের ফল হচ্ছে উন্মুক্ত কনটেইনারে রাখা হচ্ছে বর্জ্য অথবা যত্রতত্র পড়ে থাকছে ময়লা আবর্জনা। আর এসটিএস নির্মাণে দুই সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে ব্যয় করেছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কনটেইনার স্থাপন : এসটিএস নির্মাণের আগে দুই সিটি করপোরেশন প্রধান প্রধান সড়কে কনটেইনার রেখে বর্জ্য সংগ্রহ করত। সড়কে এবং উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য রাখায় বেশি ভোগান্তি পোহাতে হতো নগরবাসীকে। উন্মুক্ত স্থানের কনটেইনার থেকে সরে আসছে দুই সিটি। যদিও দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এখনো ২৫০টি উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২৪২টি ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৮টি উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলছে। দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা উৎপাদন হচ্ছে। যার ৩০ ভাগ বর্জ্য এখনো উন্মুক্ত স্থানে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের প্যাকেট পথচারীরা রাস্তায় ফেলছেন। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য এখনো বিভিন্ন সড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০ ভাগ বর্জ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গত সাত বছরে ৩ হাজার ৩২৩ কোটি খরচ করেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১ হাজার ৩০২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর উত্তর সিটি করপোরেশন ২ হাজার ২০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপেই পরিবর্তন আনা দরকার। বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ এবং ল্যান্ডফিলে সংরক্ষণ এ তিনটি ধাপেই ঝামেলা আছে। পরিকল্পিত উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রাইমারি ধাপ অর্থাৎ রাস্তাঘাটে চিপস বা পানি খেয়ে বোতল ফেলানোর কোনো জায়গা নেই। দ্বিতীয় ধাপে কিছু সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ হচ্ছে তাও আবার অপরিকল্পিত উপায়ে। পার্ক ও মাঠের কর্নারে, হাসপাতাল, স্কুল কিংবা রাস্তার পাশে নির্মাণ হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। এর জন্য জমি অধিগ্রহণ করে পরিকল্পিত উপায়ে করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বর্জ্য পৃথকীকরণ ব্যবস্থা এখনো গড়ে তুলতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তৃতীয় ধাপে বর্জ্য রাখার স্থান ল্যান্ডফিলের অবস্থাও জটিল। আমিনবাজার ল্যান্ডফিল ও মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল এরই মধ্যে ১০০ একর করে ভরাট হয়ে গেছে। নতুন অধিগ্রহণের জমিগুলো দ্রুতই ভরাট হয়ে যাবে। যদিও দুই সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী পরিকল্পিত উপায়ে সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নিতে বললেন এই নগরবিদ।

তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাস্তায় বর্জ্য পড়ে থাকা নিয়ে প্রতিনিয়ত নাগরিকদের কাছে থেকে অভিযোগ আসে। সিটি করপোরেশন সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে। রাতারাতি সবকিছু আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা সম্ভব নয়। ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫৯টি ওয়ার্ডে ৬৪ সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করেছি। আশা করছি, খুব দ্রুতই ডিএসসিসির ৭৫ ওয়ার্ডেই এসটিএস নির্মাণ হয়ে যাবে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ বা বায়ুগ্যাস করতে আমাদের কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আসছে, তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমাদের বর্জ্য থেকে যেটা উপযোগী এবং যেটাতে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হব সেটাই আমরা করব।